Friday, December 25, 2009

আমি মৌলভীবাজারের বিজয় দেখেছি। (১ম পর্ব) মির্জা আজিজ আহমদ বেগ

আমার ব্লগ ইন্টারনেটে একটি জনপ্রিয় বাংলা ব্লগ। সেখানকার এক জনপ্রিয় ব্লগার মনু পারের মানুষ মুনিম সিদ্দিকী। তার ব্লগে নিচের লেখাটি আমার চোখে পড়ে। এটি মৌলভীবাজারের অন্যতম পরিচিতমুখ মুক্তিযোদ্ধা জনাব আজিজ বেগের লেখা। আমি এই লেখাটি মনু পাড়ের মানুষদের সাথে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না। ধন্যবাদ আজিজ ভাইকে, ধন্যবাদ মুনিম সিদ্দিকীকে। এটি অনুমতি না নিয়ে রিপোস্ট করার জন্য দুঃখিত। - মিনহাজ

আমি মৌলভীবাজারের বিজয় দেখেছি। (১ম পর্ব)

মির্জা আজিজ আহমদ বেগ

আজ দীর্ঘ চার দশক পর আমি মৌলভী বাজারের গণতন্ত্রের উত্তরণ ও বিজয়ের ঘটনা লিখব বলে হাতে কলম নিয়েছি। অতীতের কত বেদনাদায়ক ও আনন্দমুখর স্মৃতি আজ চোখের সামনে ভেসে ওঠছে। আমার রাজনৈতিক সহকর্মীদের অধিকাংশই আজ বেঁচে নেই। অনাগত ভবিষ্যতের ইতিহাসে তারা যেন স্থান পান সেজন্যে লিখতে বসেছি। যারা বেচে আছেন তরাও বারবার তাগিদ দিচ্ছেন। নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্যে আমাকে লিখতে হবে। আমি কোন লেখক নই বা ডায়রীও লিপিবদ্ধ করিনি। স্থান-কাল,পাত্র,অবস্থান বিবেচনায় এ ইতিহাস লিখতে হয়ত ভুল হতে পারে। আশাকরি পাঠক ক্ষমা করবেন। স্মৃতির জানালায় যেটুকু উঁকি দিচ্ছে তাই লিপিবদ্ধ করার চেষ্ঠা করছি। ইতিহাস আমাকে এই জন্যে লিখতে হবে যেহেতু আমিই প্রথম তত্কালিন পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসার ছাত্রদের মাঝে ছাত্রলীগে যোগদান করি। আমি প্রথম মৌলভী বাজার ছাত্রলীগ গঠন করি, মৌলভী বাজার প্রথম আওয়ামীলীগ গঠন করি। মৌলভী বাজার আওয়ামীলীগ নেতাদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে শরণার্থী হয়ে ভারতে যাই। আমি মিত্রবাহিনীকে নিয়ে মৌলভীবাজারে সর্বপ্রথম ৮ই ডিসেম্বর প্রবেশ করি এবং পতাকা উত্তোলন করি। আমিই একমাত্র ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তার ঘনিষ্ট সহচর হিসেবে আড়াই বছর কারাবাস যাপন করি। আমিই প্রথম প্রতিক্রিয়াশীল স্বাধীনতা বিরোধীদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৌলভীবাজারের রাজনীতি হতে দুরে অবস্থান করছি। জানি এ ইতিহাস প্রকাশিত হলে অনেকে আমার উপর খুশি হবেন আবার অনেকে বিরাগভাজনও হতে পারেন।

২৫শে মার্চ বাঙ্গালী জাতির ভাগ্যকাশের কালো রাত্রিতে মৌলবীবাজার পাকহানাদার বাহিনী দখল করে নেয়।ফেলে। আজিজুর রহমান (তত্কালিন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য) ,প্রসন্ন কুমার রায় (ব্যবসায়ী) , বলাই বাবু , বিশিষ্ট ন্যাপা কর্মী , কানুরায় সহ , অনেক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। আজিজুর রহমান কে গ্রেফতারের পর সিলেট জেলখানায় নিয়ে যায়। প্রসন্ন বাবুকে নির্যাতন করে অর্ধমৃত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রাখে , কানুরায় ও বলাই কে অকথ্য নির্যাতন করে মেরে ফেলে, কানু রায় এবং বলাই মৌলভীবাজারের প্রথম শহীদ। মৌলভীবাজারে আরও যে সব উল্লেখ্যযোগ্য ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে তাদের মধ্যে তত্কালিন মৌলভীবাজার কলেজের বিশিষ্ট ছাত্রনেতা বর্তমানে প্রখ্যাত সাংবাদিক দৈনিক মানব জমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীও ছিলেন। তাকে গ্রেফতারের পর টি, টি, ইনস্টিটিউটে স্থাপিত ক্যাম্পে এনে অত্যাচারের পরে এক পর্যায়ে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তায় ফেলে দেয়। ২৭ শে মার্চ একাটুনা থেকে হাজার জনতা লাঠিসোটা নিয়ে মনু নদীর উত্তর পাড়ে পাক আর্মির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাক আর্মি অবস্থান নেয় নদীর দক্ষিণ পাড়ে। মৌলভীবাজরের ইতিহাসে এটাই ছিল পাক আর্মির বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ। এখানেই প্রথম সাজ্জাদুর রহমান দু’নালা বন্দুক দিয়ে পাক আর্মিদের আক্রমণ করেন। পাক আর্মিরাও জনতার উপর বেপরোয়া গুলি চালায়। এতে অনেক লোক আহত ও নিহত হন।
সাজ্জাদুর রহমানের ভাই রেনু মিয়া পাক আর্মির গুলিতে আহত হন। স্বাধীনতার পর আমি যখন মৌলভীবাজার থানার প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলাম তখন পাক আর্মির বিরুদ্ধে সাহসী সৈনিক সাজ্জাদুর রহমানের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে নাগরিক সম্বর্ধনা দিয়েছি। ২৭শে মার্চ বিকেল বেলা পাক আর্মি আমার খুঁজে আমার বাড়িতে যায় , আমি তখন লঙ্গুরপার বাজারে ছিলাম। লঙ্গুরপার বাজার আমার বাড়ি হতে এক মাইল পূর্বে অবস্থিত। সে দিন ছিল হাটবার । গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর পায় আমার অবস্থানের কথা , বাজারে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে ২/৩ জন নিরীহ লোককে হত্যা করে , তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলেন প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুল করিম মুহুরী ও তার স্ত্রী। মুহুরীর আহত মেয়ে আজ ও বেঁচে আছেন। পরের দিন চৈত্রঘাটে (আমার বাড়ির পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে) ৩০/৩৫ জন হিন্দু লোককে নির্বিচারে হত্যা করে তারা। আমার জানামতে এটাই ছিল মৌলভীবাজারের প্রথম গণহত্যা।

৪ঠা এপ্রিল শমশেসনগরে প্রতিরোধ যুদ্ধাদের এমবুশে হানাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হওয়াতে ঐ রাত্রে ওরা মৌলভীবাজার থেকে পালিয়ে যায়। ঐদিন সকালে কমাডেন্ট মানিক চৌধুরী হবিগঞ্জ থেকে আগত মুক্তিবাহিনীর একটি দল নিয়ে মৌলভীবাজার দখল করেন। তিনি মৌলবীবাজার হতে শেরপুর পর্যন্ত এলাকা ২৭শে এপ্রিল পর্যন্ত অবমুক্ত করেন। এসময় আমরা তাকে সর্বাত্নক সহযোগীতা করেছি। শেরপুর যুদ্ধে অনেক বাঙ্গালী যুবক শাহাদাত বরণ করেন , তাদের অধিকাংশ ছিলেন বর্তমান হবিগজ্ঞ জেলার অধিবাসী। এ যুদ্ধে আহত ১৫ বছরের ছাত্রলীগের কনিষ্ঠতম কর্মী আঃ মুহিত টুটু আজও বেঁচে আছেন।


২২ শে এপ্রিল আমি শহর ছেড়ে রাতে বাড়িতে এসেছিলাম, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে শুনলাম পাক আর্মি মৌলভীবাজার দখল করে নিয়েছে। আমার সাথে ছিলেন বিডিআর- এর আজিজুর রহমান সুবেদার মেজর। আমি নিঃস্ব অবস্থায় বিডিআর মেজরকে নিয়ে ভারতে কৈলাশহরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পরে বুঝতে পেরেছিলাম খবরটি সত্য ছিল না। আমি সে দিন অনিশ্চিত ভবিষত্ জেনেই এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। এ সময় প্রতিদিন হাজার হাজার শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসতে লাগল।

২৮শে এপ্রিল পাক আর্মি মৌলভীবাজার দখল করার সময় আওয়ামীলীগ ও বাম দলের অনেক বিশিষ্ট নেতার বাসা-বাড়ি আক্রমন করে এবং আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় ঐ দিন
পাক আর্মি ছিলামপুর নিবাসী উসতার মিয়া ও তার ভাইকে মাইকযোগে এলাউন্স করে মনু ব্রিজের উপর প্রদর্শনীর মাধ্যমে গুলি করে হত্যা করে। তাদের অপরাধ একটিই তারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গরু জবাই করে খাইয়েছিলেন। এ ঘটনার পেছনে ষড়যন্ত্র ছিল তত্কালিন মুসলিমলীগ নেতা ইনাম উল্লাহর।

মাত্র ১২ টাকা নিয়ে ভারতে পৌঁছালাম। পরনে একটি পাঞ্জাবী , পাজামা , আর মুজিব কোট ছাড়া কিছুই ছিল না। ভারতে পৌঁছেই খবর পেলাম পাক বাহিনী মৌলভীবাজার দখল করেনি। তাই পুনরায় ফিরে আসার উদ্যোগ গ্রহন করলাম। আমি এবং সুবাদার মেজর আজিজুর রহমান (পরবর্তীতে কৈলাশহর ন-মৌজার সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন) কৈলাশহর শহরের নিকটবর্তী চাতলাপুর বিওপি চেকপোস্টের সামনে বসে মৌলভীবাজার এসে কি করব না করব এ ব্যাপারে পরিকল্পনা করছিলাম। এসময় একজন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মেজর এসে জিজ্ঞেস করল মির্জা আজিজ বেগ কে? আমার পরিচয় দিতেই তিনি বললেন কৈলাশহরের ডিসি আপনাকে আমার সাথে যেতে বলেছেন। কৈলাশহরের ডিসি আমাকে খুঁজবেন কেন। ঠিক বুঝতে না পেরে চিন্তায় পড়ে গেলাম। এদিকে বার্তাবাহক মেজর দন্ডায়মান , দুদুল্যমান অবস্থায় ডিসির সাথে দেখা করলাম। ডিসির নাম গঙ্গাদাস আই সি এস উত্তর প্রদেশের লোক। প্রথম নজরেই মনে হল তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি। দিনটি ছিল ২৯ এপ্রিল।

No comments: